প্রবন্ধ- উন্নত বাংলাদেশ গঠনে পল্লী গ্ৰন্থাগার কেন আবশ্যক?
উন্নত বাংলাদেশ গঠনে পল্লী গ্ৰন্থাগার কেন আবশ্যক?
আকতারুল ইসলাম
যে দেশের জনগণ যত বেশি শিক্ষিত সে দেশ ততো বেশি উন্নত’, খুব ছোট বেলা থেকেই এই আপ্ত বাক্যটির সাথে আমাদের পরিচিত ঘটে। শিক্ষা যে উন্নতির একমাত্র চাবিকাঠি তা এই পবিত্র বাক্যটির মাধ্যমে বেশ ভালোভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে। আবার’ যে দেশের লাইব্রেরিগুলো যতো বেশি উন্নত সে দেশ উন্নতির মাপকাঠিতে ততো বেশি অগ্রগামী এবং সমৃদ্ধ’,এই দৈব বাণীর সাথেও আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। উন্নত দেশের ভৌতভিত্তি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর হাতে রচিত হলে,গ্ৰন্থাগারকে বলা যায় শিক্ষিত, মার্জিত ও উন্নত জাতির ভিত্তিপ্রস্তর রচয়িতা। অর্থাৎ উন্নত দেশ, শিক্ষিত (সুশিক্ষিত) জাতি ও গ্ৰন্থাগারের গুনফলের সমানুপাতিক। এখানেই আমজনতার বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গ্ৰন্থাগারের প্রকৃত ভূমিকা উপলব্ধি যায়। আমরা বর্তমান বিশ্বের উন্নত জাতি রাষ্ট্রগুলোর উন্নতির রহস্য উদঘাটন করতে গেলে গ্ৰন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা সহজেই উপলব্ধি করতে পারবো। প্রত্যেকটি জাতির উন্নতির প্রধান চালিকাশক্তি হলো সেই জাতির জ্ঞান সমাজ এবং জ্ঞান সমাজের বিকাশে গ্ৰন্থাগার পাদপ্রদীপের ভূমিকা পালন করে আসছে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই এবং সেই ধারাবাহিকতা আজ অবধি চলমান। বিশ্বায়নের এই যুগে গ্ৰন্থাগারের ভূমিকা যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ। জ্ঞান সমাজের বিস্তার ও বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের সাথে সাথে গ্ৰন্থাগারের উপযোগীতা বেড়ে গেছে অনেকগুণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেখানে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ ঘটছে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে- সর্বোপরি অগ্ৰসরমান জ্ঞান সমাজের বিকাশ ঘটছে, সেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বিশাল এই কর্মযজ্ঞকে এগিয়ে নিতে গ্ৰন্থাগার অসামান্য ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষকরে পল্লী এলাকায় গ্ৰন্থাগার স্থাপনের মাধ্যমে দেশের সিংহভাগ জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করা এবং একবিংশ শতাব্দীর সদা অগ্ৰসরমান জ্ঞান সমাজের সাথে পরিচিত করানো সময়ের দাবি।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় সত্তর ভাগ জনসংখ্যা পল্লী অঞ্চলে উৎপাদন কাজের সাথে জড়িত এবং তাদেরকে সিংহভাগই কৃষির সাথে জড়িত। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২০ অনুযায়ী দেশের মোট জিডিপির চল্লিশ শতাংশের বেশি কৃষি খাতের অবদান। তাছাড়া পল্লী এলাকায় কৃষির পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে যার মূল চালিকাশক্তি হলো আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত গ্ৰামীণ জনগোষ্ঠী। আমাদের দেশের পল্লী এলাকায় মানসম্মত শিক্ষা তেমন একটা নেই বললেই চলে এবং সেসকল নামসর্বস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেখানে গ্ৰন্থাগার সুবিধা পাওয়া আকাশ কুসুম কল্পনার সমতুল্য। যেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গুনগত শিক্ষা পাওয়া দিবাস্বপ্ন সেখানে খেটে খাওয়া সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের শিক্ষা লাভের বাসনা গরিবের হাতি পোষার পর্যায়ে পড়ে। আবার দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করা আদৌ সম্ভব নয়। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘ কর্তৃক মধ্যম আয়ের দেশের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার হাতছানি! গ্ৰামীণ জনপদকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করে তা অর্জন করা সম্ভব নয়। দেশকে উন্নয়নের সত্যিকার মহাসড়কে চড়তে হলে গ্ৰামীণ জনগোষ্ঠীকে বাহন বানিয়ে চড়তে হবে এবং তাদের দক্ষ বাহনে পরিনত করতে হবে শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে পল্লী গ্ৰন্থাগার স্থাপনই হতে পারে একমাত্র সমাধান। আটষট্টি হাজার গ্ৰাম অধ্যুষিত বাংলাদেশের অগ্ৰযাত্রায় পল্লী গ্ৰন্থাগার এক নতুন গতির সঞ্চার করবে। দেশের মফস্বল এলাকার অনগ্ৰসর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে পারলে তাদের দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করা সম্ভব হবে। উচ্চশিক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্চিত যুবসমাজকে গ্ৰন্থাগার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের সুশিক্ষিত ও কর্মদক্ষ মানবসম্পদে পরিনত করা সহজ হবে। পল্লী জনপদকে অশিক্ষা-কুশিক্ষা ও কুসংস্কারমুক্ত রাখতে হলে সবাইকে পুস্তকমুখী করতে হবে। তরুণ সমাজকে মাদক ও অপসংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে মুক্তি দিতে গ্ৰন্থাগার পালন করতে পারে অসামান্য ভূমিকা।
২০২১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় গ্ৰন্থাগার দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ছিল, “ মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, ঘরে ঘরে গ্ৰন্থাগার” যা গ্ৰন্থাগার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে আরো বেগবান করার সদূরপ্রসারি চিন্তা। মুজিব বর্ষকে কেন্দ্র করে সরকার যদি পল্লী অঞ্চলে গ্ৰন্থাগার প্রতিষ্ঠা উদ্যোগ গ্ৰহন করেন তবে তা হবে উন্নত বাংলাদেশ গঠনের অন্যতম মাইলফলক এবং এর ফলে শহর ও গ্রামের মধ্যে শিক্ষার যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা অনেকাংশে লাঘব করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সত্যিকার অর্থে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ।
Comments
Post a Comment